কাহিনী ও চরিত্র কাল্পনিক।
সকাল থেকেই আকাশে অনেক মেঘ জমে আছে। সকাল থেকে না বলে ভোর থেকে বলা ভালো। সূর্য ওঠার সময় পূবের আকাশে যে আলোর খেলা দেখা যায় তা আজ মেঘের আড়ালে ঢেকে গিয়েছিল। একটু শীত শীত করছিল সকাল থেকেই। এই সময় কিছু মানুষ ঘুমাতে ভালোবাসে। কিছু মানুষ আবার প্রকৃতি উপভোগ করতে বারান্দায় বা খোলা জায়গায় চলে যায়। কেউ বা আবার নিদ্রাহীন রাত্রির শেষ অংশ হিসেবেই জেগে থেকে কাটিয়ে দেয় এই সময়টুকু।
সাইফ সকাল থেকেই অপেক্ষা করে আছে কখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি তার একসময় খুব পছন্দ ছিল। এখন যে অপছন্দ তা ঠিক নয়। তবে আগের মতো ভালোলাগা এখন হারিয়ে গেছে। এখন বৃষ্টি কেবলই তার ফেলে আসা উজ্জ্বল স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেসব কথা মনে করতে ওর অনেক খারাপ লাগলেও এসব ভাবতেই তার ভালো লাগে। খারাপ লাগার মাঝেই ভালো লাগা খুঁজে নিয়েছে সে।
বৃষ্টিটা শেষ পর্যন্ত আর নামলো না। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিল সে। এখনও যখন নামেনি, বৃষ্টি নামার আগেই তাকে কলেজে পৌঁছাতে হবে। ঘর থেকে বের হবার সময় তার মা তার পেছন পেছন প্রায় তেড়ে এলো নাস্তার প্লেট নিয়ে। কিন্তু সে গত দুই মাসের মতো আজও ‘খাবো না’ বলে বের হয়ে গেল।
কলেজে পৌঁছানোর পরও আকাশ কেন যেন মুখ গোমড়া করে রেখেছে। যে কোনো মুহুর্তে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে। কলেজের গেটে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো সাইফ। অন্যান্য দিন রাস্তায় অনেক মানুষকে হাঁটতে দেখা যায়। আর আজ বৃষ্টির ভয়ে প্রায় কেউই বাইরে নেই। যারা আছে তারা ছাতা নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। বৃষ্টি নামলেই মাথা বাঁচাবে।
ছাতার দিকে চোখ পড়তেই সাইফের মনে পড়লো সে ছাতা আনেনি। আনবে কোত্থেকে, তার ছাতা নেই। প্রায় দেড় মাস হতে চলল বর্ষাকে সে একভাবে না একভাবে ফাঁকি দিয়ে কলেজে আসা যাওয়া করেছে। বৃষ্টিতে ভেজেনি। আজ তাই আর দাঁড়াতে সাহস করলো না। বৃষ্টি নামলে ভিজতে হবে। তাই সে কলেজে ঢোকার জন্য পা বাড়ালো।
এমন সময় কলেজের পার্কিং লটে ঢুকতে গিয়েও একটা নীল গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। গাড়িটা দেখেই চিনতে পারল সাইফ। সিনথিয়াদের গাড়ি। সিনথিয়া আর ও একই ক্লাসে পড়ে। বলা চলে, ক্লাসে সবগুলো বন্ধুর মাঝে সিনথিয়ার সাথেই তার ভালো বন্ধুত্ব। লোকে যতই বলুক ছেলে আর মেয়ের বন্ধুত্ব হয় না, সাইফ আর সিনথিয়া যেন ঠিকই দূরত্ব বজায় রেখেই একে অপরের ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে।
সিনথিয়া তাকে দেখেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো।
‘হাই সাইফ, কারো জন্য ওয়েট করছো নাকি?’
‘নাহ, কার জন্য ওয়েট করবো?’
‘না মানে তোমাকে আগে কখনো এভাবে গেইটে দাঁড়ায়ে থাকতে দেখিনাই তো তাই ভাবলাম কারো জন্য ওয়েট করছো।’
‘নাহ, কারো জন্য ওয়েট করছি না। ক্লাসে যাচ্ছি।’
‘চলো একসাথে যাই।’
সিনথিয়া আর সাইফ পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তাদের বিল্ডিং-এর দিকে চলল। সাইফ এই কলেজে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আজ প্রায় দু’মাস হতে চলল সে কলেজে উঠেছে। এই দু’মাসে নানারকম মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার। কলেজ বড়, ছাত্রছাত্রীও অনেক। অনেকের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে তার। কিন্তু সে সবার সাথেই একটা মৌখিক খাতির রেখেছে। কিন্তু নিজে খুব একা একা থেকেছে। কারো সঙ্গে ততোটা মিশেনি। বা মিশতে পারেনি। অবশ্য তার ক্লাসের দু-চারটা ছেলের সঙ্গে প্রায়ই অনেক কথা বলে। কাউকে না কাউকে তো লাগেই পড়ালেখায় মাঝে মাঝে সাহায্যের জন্য। আর সেই ছেলেগুলোর কথা বাদ দিলে এই কলেজে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু সিনথিয়া।
সিনথিয়া প্রথম দিন নিজেই তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। কলেজে টিফিনের সময় ক্লাসরুম প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। যারা থাকে তারা বাসা থেকে টিফিন বক্সে খাবার আনে। আর থাকে সাইফ। তাকে আজ পর্যন্ত কেউ টিফিনে কিছু খেতে দেখেনি। অন্যরা এটা নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও সিনথিয়ার বেশ অবাক লেগেছিল। তাই সে নিজেই এসে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল সে কখনো টিফিন খায় না কেন।
সাইফ বলেছিল, ‘বাসা থেকে বেশি করে খেয়ে আসি তো, তাই আর খিদে পায় না।’
সিনথিয়া চোখ সরু করে ‘ও আচ্ছা’ বললেও মিথ্যেটা সে টের পেয়ে গিয়েছিল। বাসা থেকে খেয়ে আসলে কারও মুখ অমন শুকনো থাকে না। তবে সে কথা সে প্রকাশ করল না। জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি এখানে নতুন?’
সাইফ হাসলো, ‘ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি, নতুন না হয়ে পুরান হবো কী করে?’
‘না মানে, এখানে তো স্কুলও আছে। এখান থেকেই পাশ করেছ নাকি সেটা জিজ্ঞেস করছিলাম।’
‘না না, এখান থেকে পাশ করিনি। এই কলেজে আমি নতুনই।’
‘হুমম,’ মাথা নাড়লো সিনথিয়া। প্রথম দিন সাইফের সঙ্গে তার কথা হয় এতটুকুই।
সিনথিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিল সাইফ। এতোটাই মগ্ন ছিল যে প্রবল বৃষ্টির কিছুই সে টের পায়নি। সিনথিয়া যখন তাকে হ্যাঁচকা টানে বারান্দায় উঠালো তখন যেন তার হুঁশ ফিরল। অবাক হয়ে দেখল সে আরেকটু হলেই ভিজে চুপচুপে হয়ে যাচ্ছিল। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বারান্দার একদম ভিতরের অংশে দাঁড়িয়েও পা ভিজে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। সিনথিয়া তার সামনে হাত নাড়লো। ‘জনাব কি পান্ডোরায় চলে গেছেন?’
‘পান্ডোরা?’
‘অ্যাভাটার।’
‘ওহ, না। পান্ডোরায় যাবো কেন?’
‘দুনিয়ায় তো মন নেই দেখছি। কী ভাবছিলে?’
‘না কিছু না। হোমওয়ার্কের খাতাটা এনেছি কি না সেটা ভাবছিলাম।’
হা হা করে হাসতে শুরু করলো সিনথিয়া। বৃষ্টির শব্দ না থাকলে বোধহয় পুরো কলেজের সবাই সে হাসির শব্দ শুনতে পেত। হাসতে হাসতে সে বলল, ‘হোমওয়ার্কের খাতা এনেছ কি না তাই এতো গভীরভাবে ভাবছিলে? তুমি যে একটা কী…’ হাসতে হাসতে সে ক্লাসরুমের দিকে এগোলো। আর তার পেছন পেছন সাইফও ক্লাসে গিয়ে ঢুকলো।
২
টিফিনের ঘণ্টা পড়লো। ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্রদের আগে স্যারই যেন দৌড়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলেন। তার পেছন পেছন অন্য স্টুডেন্টরাও বের হলো। স্বভাবমতো সাইফ তার খাতাটা বের করলো। বাসার কাজ এগিয়ে রাখবে। আর তখনই দানবীয় মূর্তি ধারণ করে সিনথিয়া এসে তার হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিজের ব্যাগে ভরলো।
সাইফ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উফফ, সিনথি নট অ্যাগেইন।’
সমান তেজে সিনথিয়া বলল, ‘ডেফিনিটলি ওভার অ্যান্ড ওভার অ্যাগেইন। চলো, ক্যান্টিনে আজ বার্গার দেখলাম। আজ বার্গার খাওয়ার পালা।’
‘আমি খেতে পারবো না। তুমি যাও তো। আমাকে নিয়ে ঠেলাঠেলি করো না।’
অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাইফকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে ক্যান্টিনের দিকে নিয়ে গেল। তা দেখে ক্লাসের দু-একটা ছেলে হাসতে থাকলো। সাইফ দূর থেকেও শুনতে পেল যে তারা বলছে, ‘হেডমিস্ট্রেসগিরি শুরু হয়ে গেছে ম্যাডামের!’
ক্যান্টিনে গিয়ে একটি বার্গার কিনলো সিনথিয়া। নিজে অর্ধেকটা রেখে বাকি অর্ধেকটা প্রায় জোর করে সাইফের হাতে ধরিয়ে দিল। সত্যি কথা বলতে কি, অর্ধেকটা বার্গারে সিনথিয়ার কিছুই হয় না। এখানের বার্গারগুলোও সাইজে অনেক ছোটো। কিন্তু সাইফ জীবনেও অর্ধেকটার বেশি বার্গার খাবে না। তাই রীতিমতো বাধ্য হয়েই সাইফের জন্য অর্ধেকটা বার্গার উৎসর্গ করে সিনথিয়া।
প্রথম দিন অনেকটা নাটকীয়ভাবেই এভাবে সাইফকে টিফিন খাওয়ানোর কাজ শুরু করে সিনথিয়া। সাইফকে তার বেশ পছন্দ। বন্ধু হিসেবে তো ভালোই, ছাত্র হিসেবে এমনকি ব্যক্তি হিসেবেও ও বেশ ভালো একটা ছেলে। কিন্তু এভাবে না খেয়ে মুখ তো পেঁচার মতো করছেই, নিজের স্বাস্থ্যও নষ্ট করে ফেলছে। সিনথিয়ার এটা খুব খারাপ লেগেছে। তাই সে একদিন টিফিনের সময় গিয়ে বলছে, ‘আমাকে উইশ করো।’
খানিকটা অবাক হয়ে সাইফ জিজ্ঞেস করল, ‘কী উপলক্ষ্যে?’
সিনথিয়া হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল, ‘আমার বার্থডে।’
‘ওহ তাই নাকি? হ্যাপি বার্থডে!’ এই বলে প্যাড থেকে কাগজ ছিঁড়ে সেখানে একটা ফুল একে সিনথিয়াকে দিল সাইফ। বলল, ‘আগে বললে হয়তো গিফট পেতে। হঠাৎ বলেছ তাই কাগজের ফুল!’
ফুলটা নিয়ে সিনথিয়া বলল, ‘নট আ প্রবলেম। এমনিতেও আমি গিফট টিফট নিতে কমফোর্ট ফিল করি না।’ এনিওয়ে, আজ কে কে টিফিন আনেনি তাদেরকে আমি খাওয়াবো।’ এই বলে মোটামুটি ১২ জনকে টিফিন খাওয়ালো সিনথিয়া। সেদিন বেশ সহজভাবেই টিফিন খেয়েছিল সাইফ। জন্মদিনের বাহানায় সবার সঙ্গে সঙ্গে সাইফকেও সে খাইয়ে দিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, সেদিন সিনথিয়ার জন্মদিনই ছিল না।
সেদিন বেশ হাসাহাসি হয়েছিল। বিশেষ করে ফুলটা নিয়ে সবাই হেসেছিল। সাইফও অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশিই হেসেছিল। কিন্তু এতো হাসি-আড্ডার মাঝে সাইফের দেয়া কাগজের ফুলটা অতি যত্নের সাথে সিনথিয়ার রেখে দেয়াটা কেউই খেয়াল করেনি।
Pingback: My Best Friend Simi (পর্ব ২) | আমিনুল ইসলাম সজীবের বাংলা ব্লগ
প্রথম পর্বটি পড়লাম………
ভাল লিখেছেন……………………সময় করে বাকিগুলো পড়ব……
গল্পের থিম সুন্দর। শুধু সব কিছু ব্যাখ্যা করে না দিয়ে পাঠকের কল্পনার জন্যে কিছু ইঙ্গিতময়তার ব্যবহার করা গেলে আরো আকর্ষণীয় হবে বলে মনে হয়। তবে নিরন্তর চর্চার অব্যাহত থাকুক, হয়ে যাবে একসময়।
ধন্যবাদ। লেগে থাকুন।